ইসলামের প্রথম শতকের জ্ঞানের অম্লান ধারা ও আধ্যাত্মিক সাধনার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)। তিনি তাবেয়িদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবন ছিল অনন্য জ্ঞান, সততা, তাকওয়া ও দুনিয়াবিমুখতার এক মহাকাব্য। সাহাবিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার আলোকে তিনি ইসলামের বিভিন্ন শাখায় যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি আধ্যাত্মিকতার এক গভীর পথিকৃত হিসেবে নিজের অবস্থান স্থাপন করেছেন।

জন্ম ও বংশপরিচয়:
হিজরি ১৫ সালে (৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) মদিনার পুণ্যভূমিতে হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুরাইশ বংশের ‘মাখযুম’ শাখার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর দাদা হজরত হাযন (রাদিআল্লাহু আনহু) ছিলেন একজন জলিলুল কদর সাহাবি। এক অনন্য বরকতময় মুহূর্তে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং তাঁর দাদার নাম ‘হাযন’ (দুঃখ) থেকে পরিবর্তন করে ‘মুসায়্যিব’ রাখেন, যার অর্থ— “সঠিক পথে অটল।” (১) এই নামকরণ যেন তাঁর জীবনের এক পূর্বাভাস ছিল; তিনিই পরবর্তীকালে জ্ঞান, তাকওয়া ও আধ্যাত্মিকতার এক সৌভাগ্যবান নক্ষত্র হিসেবে দ্যুতি ছড়িয়েছেন।

জ্ঞানার্জন:
বাল্যকাল থেকেই সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.)-এর হৃদয়ে ইলম অর্জনের এক অপ্রতিরোধ্য স্পৃহা প্রোথিত ছিল। তিনি মসজিদে নববীর পবিত্র প্রাঙ্গণে সাহাবিগণের মজলিসে বসে জ্ঞান আহরণ করতেন। বিশেষভাবে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.)-এঁর সঙ্গ সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতেন এবং তাঁর কাছ থেকে অসংখ্য হাদিস শ্রবণ ও মুখস্থ করতেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি প্রায় ১৬০০ হাদিস মুখস্থ করেছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল ‘মুরসাল’ হাদিস (অর্থাৎ, যেখানে তাবেয়ি সরাসরি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন)। হাদিস সংরক্ষণে তাঁর এই অবদান তাঁকে পরবর্তীকালের মুহাদ্দিসগণের নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছে। (২)

মদিনার ‘সাত ফুকাহা’র অন্যতম ও ফিকহের স্থপতি:
হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.) ছিলেন মদিনার বিখ্যাত ‘সাত ফুকাহায়ে কিরাম’ (الفقهاء السبعة)-এঁর অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাঁর ফিকহি জ্ঞান, গভীর প্রজ্ঞা এবং শরয়ি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিচক্ষণতা ছিল অনন্য। তাঁর ফাতোয়া ও ইজতিহাদ এতটাই নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য ছিল যে, পরবর্তীকালের মহান ইমামগণও, যেমন ইমাম মালেক (রহ.) তাঁর জ্ঞানের গভীরতার প্রশংসা করতেন এবং তাঁকে ফিকহি ধারার অন্যতম স্থপতি হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁর ফিকহি দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামি আইনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। (৩)

হজরত আবু হুরাইরা (রাদিআল্লাহু আনহু)-এর জামাতা:
হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.)-এঁর তাকওয়া ও চারিত্রিক পবিত্রতা এতটাই উচ্চ মার্গের ছিল যে, হজরত আবু হুরাইরা (রাদিআল্লাহু আনহু) স্বয়ং তাঁর একমাত্র কন্যাকে এই আল্লাহওয়ালা যুবকের হাতে তুলে দেন। এই বিবাহ শুধু দুই ব্যক্তির মিলন নয়; বরং দুটি পবিত্র আত্মার একীভূত হওয়া। বিবাহের প্রথম রাতে নববধূর ঘরে প্রবেশ করে সাঈদ (রহ.) বলেছিলেন, “আমি চাই, এই ঘর যেন আল্লাহর জিকিরে মুখরিত হয়ে শুরু হয়।” এই বিরল ঘটনা তাঁদের জীবনের পবিত্রতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি তাঁদের গভীর নিষ্ঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তাঁদের প্রথম রাত কেটেছিল কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়ার মাধ্যমে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিবাহিত জীবনের আদর্শের এক অনবদ্য উদাহরণ। (৪)

ইবাদত ও রিয়াযত:
হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.) ছিলেন ইবাদতের এক অবিচল প্রতিমূর্তি। তিনি টানা ৪০ বছর ধরে আজানের পূর্বেই মসজিদে নববীতে উপস্থিত থাকতেন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি তাঁর ইবাদতের গভীরতা প্রকাশ করে। তা হচ্ছে, “আমার জীবনের বিশেষ ৫০ বছরে এমন কোনো রাত আসেনি যে, আমি ফজরের সালাত জামাআতের সাথে আদায় করিনি।” এই অবিরাম একনিষ্ঠতা কেবল তাঁর শারীরিক উপস্থিতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তাঁর অন্তরও আল্লাহর জিকির ও ধ্যানে ডুবে থাকত। তাঁর জীবন ছিল আত্মিক প্রশান্তি, আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং নির্ভুল তাকওয়ার এক জীবন্ত চিত্র। (৫)

রাজনৈতিক নির্ভীকতা:
উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাঁর পুত্র ওয়ালিদের সাথে হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.)-এঁর মেয়েকে বিবাহ করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাঈদ (রহ.) এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে তাকে বেত্রাঘাত করা হয় এবং প্রকাশ্যে অপমান করা হয়। এত কিছুর পরও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।
(ইমাম ইবন কাসীর,আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া,খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৯৯)

সুফিদের দৃষ্টিতে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.):
হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.)-কে সুফিসাধকগণ উচ্চ আসনে স্থান দিয়েছেন। তাঁর জীবন ছিল আত্মিক বিশুদ্ধতা ও আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর তাকওয়া ও লজ্জাশীলতা এত প্রবল ছিল যে, কেউ তাঁর চোখে চোখ রাখতে সাহস পেত না। তাঁর ব্যক্তিত্বে এক প্রকার আধ্যাত্মিক গাম্ভীর্য ছিল, যা তাঁকে সাধারণের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।

ইমাম কুশাইরি (রহ.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, “সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.) ছিলেন কাশফ ও অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী।” (৬)
ইমাম আবু নু’আইম আল-ইসফাহানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“তিনি ছিলেন পরহেজগারির ইমাম, দুনিয়া বিমুখ, হাদিসে নির্ভরযোগ্য, এবং আধ্যাত্মিক মর্যাদাসম্পন্ন।” (৭)
শাইখ আব্দুল ওহ্হাব আশ-শারানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “তিনি আল্লাহর অলিদের অন্যতম এবং আধ্যাত্মিক অবস্থান ও মারফতের অধিকারী।” (৮)

কারামত :
রোগমুক্তি ও রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এঁর স্বপ্ন:
ইমাম জাহাবী (রহ.) তাঁর সিয়ার আ’লামুন নুবালা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এক ব্যক্তি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বপ্নে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে দেখলেন, তিনি বললেন, “সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিবের কাছে যাও, তিনি তোমার জন্য দোয়া করলে আল্লাহ তোমার শিফা দান করবেন।” লোকটি সাঈদ (রহ.)-এঁর কাছে গিয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করলে, তিনি মাথা নিচু করে দোয়া করেন এবং পরের দিন থেকেই লোকটির রোগ উপশম হতে শুরু করে। (৯)

‘ফাসিক’ যুবকের জানাযা:
আরেকটি ঘটনায় জানা যায়, যখন শহরের লোকজন একজন ‘ফাসিক’ (পাপী) যুবকের জানাযা পড়তে রাজি হচ্ছিল না, তখন হজরত সাঈদ (রহ.) বলেছিলেন, “তোমরা অন্তর জানো না; কেবল বাহ্যিকতা দেখেই সিদ্ধান্ত নিও না।” তিনি নিজে সেই জানাযা পড়ালেন। পরে জানা যায়, ঐ যুবক মৃত্যুর পূর্বে কুরআন হাতে নিয়েই ইন্তেকাল করেছিলেন, যা তাঁর অন্তরের গোপন ঈমানকে প্রকাশ করে। (১০)

মসজিদে নববীতে একাকী আজান শোনা:
হাররার যুদ্ধের সময় যখন মসজিদে নববী জনশূন্য হয়ে পড়েছিল, তখন হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.) একাকী মসজিদে অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন, নামাজের সময় হলে তিনি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এঁর রওজা মুবারক থেকে আজানের শব্দ শুনতে পেতেন। (১১)

তাঁর কয়েকটি অমূল্য বাণী:
১. “নফসকে যদি প্রশ্রয় দাও, তা তোমার ঈমানকে গিলে খাবে।” (১২)
২. “তোমার অন্তর যদি আল্লাহকে নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকে, তবে বাহ্যিক আমল কোনো কাজে আসবে না।” (১৩)
৩. একবার এক রাজকীয় উপহার ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন: “যে হাত আল্লাহর জন্য উঠেছে, সে কখনও বাদশার দরজায় মাথা নত করে না।” (১৪)
৪. “যে আল্লাহকে চেনে না, সে হাসে। আর যে চেনে, সে কাঁদে।”
৫. “তাকওয়া এমন পোশাক, যা ছিঁড়ে গেলে আর কিছুই থাকে না।”
৬. “হালাল রিজিক কামানো জিহাদের চেয়ে কম নয়।” (১৫)

শিক্ষাদান ও ছাত্র:
তাঁর মজলিস ছিল নীরবতা ও আধ্যাত্মিক সৌরভে পূর্ণ—যেখানে জ্ঞান বিতরণ হতো প্রেমের সাথে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমগণ, তথা ইমাম ইবনে শিহাব জুহরি, ইমাম আওযাঈ, ইমাম কাতাদা এবং ইমাম আবু ইসহাক। তাঁর ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে কেবল হাদিস ও ফিকহের জ্ঞানই অর্জন করেননি; বরং তাঁরা তাঁর জীবন থেকে তাকওয়া, বিনয়, আধ্যাত্মিকতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। (১৬)

ইন্তেকাল:
৯৪ হিজরি/৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে মদিনার পবিত্র ভূমিতে এই মহান ব্যক্তিত্ব ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে মদিনার বাতাসে এক বিষাদের সুর বেজে উঠেছিল। মসজিদে নববীর মেঝেতে বসে মানুষ শোক প্রকাশ করেছিল। তাঁর মৃত্যুতে জ্ঞান, তাকওয়া ও আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছিল, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও শিক্ষা আজও মুসলিম উম্মাহকে আলোকিত করে চলেছে। ১৭

তথ্যসূত্র:
১.ইবনে সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১২০
২.ইবনে হাজার, তাহযিবুত তাহযিব, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৮৪,যাহাবী, সিয়ার আ’লামুন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২১৮
৩.ইবনে কাসীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৩২৮, ইবনে সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১৪
৪. আবু নু’আইম আল-ইসফাহানী, হিলয়্যাতুল আওলিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৬৫
৫. আবু নু’আইম আল-ইসফাহানী, হিলয়্যাতুল আওলিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৬২, যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৫
৬. ইমাম কুশাইরি, আর রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, বাবুল কারামাত
৭.আবু নু’আইম আল-ইসফাহানী, হিলয়্যাতুল আওলিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৭
৮.শাইখ আব্দুল ওহ্হাব আশ-শা’রানী, তাবাকাতুল কুবরা, খন্ড ১
৯. যাহাবী, সিয়ার আ’লামুন নুবালা, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৭
১০. ইমাম আবুল ফারায আব্দুর রহমান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-জাওযী, সিফাতুস সাফওয়া,৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৫
১১.ইমাম আবুল ফারায আব্দুর রহমান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-জাওযী, সিফাতুস সাফওয়া,৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৫
১২.ইমাম আবুল ফারায আব্দুর রহমান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবন আবিদ দুনিয়া,মাকাইদুশ শায়তান
১৩.আবু নু’আইম আল-ইসফাহানী, হিলয়্যাতুল আওলিয়া,
১৪. ইমাম কুশাইরি, আর রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ
১৫. ইবনে আল-জাওযী, সিফাতুস সাফওয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৫৭
১৬. যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৫
১৭. ইবনে সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১২৫