শাহানশাহ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ছিলেন বাংলাদেশের মাইজভাণ্ডারী তরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক, যিনি তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন, সাধনা, কেরামত এবং মানবতার সেবার জন্য বিশ্বব্যাপী সম্মানিত। তিনি বিশ্বঅলি, জিয়া বাবা, শাহেনশাহ নামে পরিচিত এবং তাঁর জীবন ছিল আল্লাহর প্রতি নিবেদন, সরলতা এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত।

হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ১৯২৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর (১০ পৌষ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, ১২ রজব ১৩৪৭ হিজরী) চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অছিয়ে গাউছুল আজম শাহসুফি হজরত সৈয়দ দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারীর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং গাউছুল আজম বিল বেরাসত হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারীর (বাবা ভাণ্ডারী) দৌহিত্র। তাঁর জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল বদিউর রহমান, কিন্তু তাঁর পিতা ঐশী নির্দেশে তাঁর নাম পরিবর্তন করে জিয়াউল হক রাখেন। তাঁর মা ছিলেন সৈয়দা সাজেদা খাতুন, যিনি ছিলেন বাবা ভাণ্ডারীর দ্বিতীয় কন্যা। তাঁর পিতা হজরত দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী এই তরিকার উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই আধ্যাত্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী শৈশব থেকেই সুফিদর্শন ও আধ্যাত্মিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর পিতা ও পিতামহের শিক্ষা ও প্রভাব স্পষ্ট ছিল।

তার জীবনের সাধনার পথ মোটামুটি নিম্নরূপ—
যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হজরতের রওজার দিকে কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়— খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়— পণ আর ছোটে না৷

হজরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা দেলাওর হোসাইন। হোসাইনি মেজাজ। ছেলেকে হুজরায় ডেকে সাওয়াল জাওয়াব শুরু। পুত্রের সাওয়াল—“হযরত কেবলা কে? বাবাজান কেবলা কে?” বাবা জবাব দেয়—“আল্লাহর অলি, দুয়ে মিলে এক।” প্রশ্নের পরিধি বাড়ে। বাবাকে জিগান বাবার পরিচয় কী? গাউসের অছি—অছি-এ গাউছুল আজম। মেজাজ চটে যায়। “আমি কে চেনো না? আমাকে দেখবে? কী যেন ঘটে তারপর… দরজা খোলা হয়। পিতার মুখমণ্ডল রক্তিম। পূত্র কোনোরকম বসে আছে। টলে পড়ার উপক্রম। শরীরের অবস্থা বেগতিক।

পরদিন হজরতের রওজায় লম্বা সিজদা। প্রায় দুঘণ্টা৷ লোকে জানতে চায়—কী ঘটেছে গতকাল। যুবক এভাবে সিজদাবনত কেন? অছি-এ গাউসুল আজম উত্তর করেন—“আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিরক্ত করছিলো। মেজাজ চটে গিয়েছিল। তাঁর উপর যা ঢালা হয়েছে তা পাহাড়ে ঢাললে পাহাড় টলে যেত। সাগরে ঢাললে তা জনশূন্য মরুভূমি হয়ে যেতো। হযরতের রক্তধারা বলে সে টিকে গেছে।” যুবকের বর্ণনা মতে তাঁর সিনা জ্বলেপুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।

তিনদফা স্বপ্ন দেখে তিন ভক্ত। স্বপ্নে হজরত আসেন, আসেন বাবাজান কেবলাও। অভয় দেন। সুখবর শোনান—“টেনশনের কিছু নাই, তাকে আলোকবর্তিকা-রূপে তৈরি করা হচ্ছে।” সাধকপুরুষ সাধনসিদ্ধ হয়। হজরত কেবলা যুবকের পিতাকে স্বপ্নে আদেশ দেন— “জিয়াউল হক মিঞাকে আমার আমানত অর্পণ করো।” ব্যাস, তাঁর গায়ে হজরতের চাদরজোড়া জড়ানো হয়। চাদর নয়, যেন হজরতকেই সর্বাঙ্গে জড়ালেন। স্বপ্নে এসে তাজও পরালেন। সাধক জিয়াউল হক পৌঁছে গেলেন অভীষ্টে। তাঁর তিনিকে তিনি তাঁর মত করে দেখলেন, চিনলেন, জানলেন। অতপর ফরমালেন, “নিজের ভেতর দৃষ্টি দাও, বহির্জগতের চেয়েও সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাবে।” বললেন, “হালাল খাও, নামাজ পড়ো, আল্লাহ আল্লাহ জিকির করো, সব সমস্যা মিটে যাবে।”

তারপর বেলায়তি কাণ্ডকারখানা শুরু হয়। কখনও ঘূর্ণিঝড়ের মুখ অন্যত্র ফিরিয়ে বাংলাদেশকে বাঁচান তো কখনও পেট মেজে, চা খাইয়ে ক্যান্সার ভালো করেন। কখনও হাজার ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারও তাঁকে টলাতে পারেন না, কখনও বা তাঁর আদেশে মধ্যাকর্ষণ বল থেমে গিয়ে আপেল শূন্যে ভাসতে থাকে। আবার কখনও দেখা যায় এক ছটাকী প্লেটে দুই লিটার পানি হজম করাতে। ঐ যে, এক বদনায় পুরো আনা সাগর। তেমন আর কী! যে যেখানে যায় সেখানেই দেখে। কখনও মক্কা-মদিনা, কখনও বাগদাদ-আজমির কিংবা কখনও ইউরোপ-আমেরিকা। কোথায় নেই তিনি? একই সময়ে। যার উপর-নিচ, ডান-বাম ঘুচে যায়, তার সবখানে থাকাটা আর এ আশ্চর্যের কী? দরবেশ বজলুল করিম মন্দাকিনী-ই বেশ দারুণ লিখেছেন—
তুর প্যালেস্টাইন, দামেস্ক-মিশরে
মহাসমারোহে মদিনা নগরে
বাগদাদ-আজমিরে পেয়েছি তোমারে
অপার করুণা দান—
কে তুমি হে সখা আড়ালে থাকিয়া
হরিলে আমার প্রাণ…

জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীর শিক্ষাজীবন ছিল আধ্যাত্মিক ও পার্থিব জ্ঞানের সমন্বয়। তিনি শৈশবে মৌলভী মোজাম্মেল হকের কাছে আরবি বর্ণমালা, কালিমা এবং ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন। এরপর তিনি মাইজভাণ্ডার আহমদীয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি নানুপুর আবু সোবহান হাই স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন এবং স্নাতক শিক্ষার জন্য কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ ডিগ্রি কলেজে অধ্যয়ন করেন। তবে, তাঁর শিক্ষার প্রধান ক্ষেত্র ছিল আধ্যাত্মিক জ্ঞান। তাঁর পিতা হজরত দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী তাঁকে সুফি তরিকার গভীর শিক্ষা দান করেন।

জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ছিলেন একজন মজ্জুব-ই-সালেক, অর্থাৎ তিনি আধ্যাত্মিক মগ্নতা এবং তরিকার পথচলার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। তাঁর জীবন ছিল সাধনা, ত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠার এক অনন্য উদাহরণ। তিনি পাহাড়, বন, সমুদ্র উপকূল এবং প্রকৃতির বিভিন্ন স্থানে দিনের পর দিন ভ্রমণ করতেন এবং সেখানে ধ্যান ও জিকিরে মগ্ন থাকতেন।

হজরত জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার তাঁর পুত্র হজরত সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভাণ্ডারী (ম.জি.আ.) এঁর মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘শাহানশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্ট’ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা, সেলাই প্রশিক্ষণ, শিক্ষাবৃত্তি এবং অন্যান্য সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।তাঁর ওরশ প্রতি বছর মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। এই সময় হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হন এবং তাঁর শিক্ষা ও দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁর শিক্ষা আজও মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুসারীদের জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে।

১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর জীবন ছিল সাধনা, ত্যাগ, এবং মানবতার সেবায় নিবেদিত। তাঁর জীবন ও কাজ মাইজভাণ্ডারী তরিকার মাধ্যমে আজও অমর হয়ে আছে এবং অসংখ্য মানুষের জীবনে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে। তাঁর দর্শন ও শিক্ষা সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠার বাণী বহন করে, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও প্রাসঙ্গিক থাকবে।

গ্রন্থসূত্র: শাহানশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.), লেখক জামাল আহমদ সিকদার, ১৯৮২।