ইতিহাসের কালপরিক্রমায় কিছু জীবন মহাকাব্যের মতো স্নিগ্ধ আলো ছড়ায়, যা শুধু তথ্য নয়, অনুভব দিয়েও স্পর্শ করা যায়। ওয়াইস ইবনে আমির ইবনে জাজ আল-কারনী (রাদিআল্লাহু আনহু) ছিলেন তেমনই এক মহাকাব্যিক চরিত্র, যাঁর জীবন ছিলো নবীপ্রেম, মাতৃভক্তি, আর দুনিয়াবিমুখতার এক ভাস্কর্য-স্বরূপ। তিনি সশরীরে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সংস্পর্শ পাননি, কিন্তু তাঁর আধ্যাত্মিক উচ্চতা ও আত্মনিবেদন এমনই ছিলো যে, তাঁকে ‘খায়রুত তাবেয়িন’ (তাবেয়িনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ) উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। তাঁর জীবন যেন নিভৃতে জ্বলা এক প্রদীপ, যার আলো দূর থেকে দিকনির্দেশনা দেয়। তাঁর জীবনগাঁথা শাশ্বত মানবতার এক অনন্য দলিল, যা আজও কোটি হৃদয়ে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার দীপশিখা জ্বেলে চলেছে।
হযরত ওয়াইস আল-কারনী (রাদিআল্লাহু আনহু)-এঁর জন্মসন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, তিনি ইসলামের প্রথম যুগের প্রথম দিকে, সম্ভবত ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষার্ধে (আনুমানিক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে) ইয়েমেনের ‘কার্ন’ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম ছিল ওয়াইস ইবনে আমির ইবনে জাজ ইবনে মালিক আল-কারানী আল-মুরাদী।
শৈশবেই পিতার ছায়া হারানো এই যুবক মায়ের সেবাকেই নিজের জীবনের ব্রত করে নেন। তাঁর মা ছিলেন অতিশয় বৃদ্ধা, দৃষ্টিশক্তিহীন এবং শারীরিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। মায়ের এই অসহায়ত্বের ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন পরম ভালোবাসায়, যা ছিল তাঁর জীবনের প্রধান দায়িত্ব। দিনের বেলায় উট চরিয়ে যে সামান্য উপার্জন করতেন, তা দিয়ে মায়ের সেবা করতেন এবং সংসারের ভরণপোষণ চালাতেন। এই মাতৃভক্তিই তাঁকে সাধারণের ঊর্ধ্বে এক বিশেষ স্থানে স্থাপন করেছিল, যা দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে তাঁর কাছে অধিক মূল্যবান ছিল।
এই সাধারণ জীবনের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক অসাধারণ অন্তরাত্মা, যাঁর হৃদয়ে ছিল আল্লাহর প্রতি অগাধ প্রেম আর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি নিগূঢ় আকর্ষণ। তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা এবং পার্থিব বিষয়ে নির্লিপ্ততা অনেক সময় মানুষকে ভুল বোঝাতে পরিচালিত করতো। মানুষ তাঁকে ‘পাগল’ বা ‘বুনো’ মনে করতো। অথচ তাঁর এই তথাকথিত ‘পাগলামি’ ছিল দুনিয়ার মায়াজাল থেকে তাঁর আত্মার মুক্তি। যখন মানুষ দুনিয়ার প্রাপ্তিতে হাসত, তাঁর চোখ থেকে নির্গত হতো নীরব অশ্রুধারা; কারণ তিনি জানতেন, এই হাসি ক্ষণস্থায়ী এবং অর্থহীন। আর যখন মানুষ দুনিয়ার ক্ষতিতে কাঁদত, তাঁর মুখে ফুটে উঠত মৃদু হাসি; কারণ তিনি বুঝতেন, এই ক্ষতি আসল প্রাপ্তির পথে এক ধাপ এবং আখিরাতের অনন্ত জীবনের তুলনায় অতি তুচ্ছ। এই বৈপরীত্যই ছিল তাঁর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির গভীরতার প্রমাণ, যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য ছিল না।
হজরত ওয়াইস আল-কারনী (রাদিআল্লাহু আনহু) কখনও সরাসরি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেননি, কিন্তু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সম্পর্কে বহুবার আলোচনা করেছেন এবং তাঁর মর্যাদা তুলে ধরেছেন। এটিই তাঁর অনন্যতার পরিচায়ক, যা তাঁকে সাহাবি না হয়েও বিশেষ সম্মানের অধিকারী করেছে। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রায়শই ইয়েমেনের দিকে ফিরে বলতেন: “ইন্নি লা-আজিদু নাফসার রহমান মিন কিবালি ইয়ামেন (আমি ইয়ামেনের দিক থেকে রহমানের সুবাস অনুভব করছি)।”(১) এটি ওয়াইস আল-কারনির প্রতি এক অদৃশ্য ইশারা ছিল, যা তাঁর আধ্যাত্মিক অবস্থান এবং আল্লাহর নৈকট্যের গভীরতা প্রকাশ করে। এই উক্তি থেকেই ওয়াইসের আত্মিক পবিত্রতা ও আল্লাহর রহমতের সান্নিধ্যের কথা সুস্পষ্ট হয়।
কেবল এটিই নয়, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর প্রিয় সাহাবি হজরত ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু) এবং হযরত আলী (রাদিআল্লাহু আনহু)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: “তোমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি আসবে ইয়েমেন থেকে, যাকে ওয়াইস বলা হয়। সে তার মায়ের খুব অনুগত থাকবে। তার শরীরে কুষ্ঠরোগের চিহ্ন থাকবে, যা একমাত্র একটি দীনার পরিমাণ স্থান ব্যতীত সব জায়গা থেকে সেরে যাবে। যদি সে আল্লাহর নামে কসম করে কিছু চায়, আল্লাহ তা পূরণ করবেন। তোমাদের মধ্যে যে তার সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন তার কাছে নিজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয়।” (২)
নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এমন একজন আছে, যাকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন রাবিয়াহ ও মুদারের ভেড়ার পশমের সমপরিমাণ মানুষের জন্য সুপারিশের অনুমতি দেবেন।” সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহর রসুল, তিনি কে?” নবীজি বললেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একজন।” সাহাবিরা আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “তাঁর নাম কী?” তিনি বললেন, “ওয়াইস।” তারা জানতে চাইলেন, “তিনি কোথায়?” নবীজি বললেন, “কার্ন-এ।” সাহাবিরা আশ্চর্য হয়ে বললেন, “তিনি তো নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহচর্য পাননি!” নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “দুটি জিনিস তাকে বাধা দিয়েছে; প্রথমটি হলো তীব্র আধ্যাত্মিক অবস্থা (গলাবাতুল হাল), দ্বিতীয়টি হলো শরিয়তের প্রতি অত্যাধিক শ্রদ্ধা (তাজিমুশ শরআ)। কারণ তাঁর একজন দুর্বল, অন্ধ চোখ এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাত-পা বিশিষ্ট মা ছিলেন। তিনি দিনে মজুরি নিয়ে উট চরাতেন এবং সেই মজুরি দিয়ে নিজের ও মায়ের ভরণপোষণ চালাতেন।” সাহাবিরা আবারও জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমরা কি তাকে দেখতে পাব?” নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “আবু বকর তাকে দেখতে পাবে না, তবে ওমর ও আলী তাকে দেখতে পাবে। সে একজন ঘন চুলের অধিকারী ব্যক্তি, তার একপাশে এবং দুই হাতের তালুতে দীনার পরিমাণ সাদা দাগ থাকবে, যা কুষ্ঠরোগ নয়। যখন তোমরা তার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন আমার পক্ষ থেকে তাকে সালাম জানাবে এবং আমার উম্মতের জন্য তার কাছে দোয়া চাইবে।” (৩)
যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এঁর ওফাতের সময় ঘনিয়ে এলো, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিআল্লাহু আনহু) অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আপনার চীরকা (মোটা পশমের পোশাক) কাকে দেব?” উত্তরে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “ওয়াইস আল-কারনিকে।” (৪)
এই উক্তিটি হজরত ওয়াইস আল-কারনী রাদিআল্লাহু আনহুর প্রতি নবীর গভীর ভালোবাসা ও তাঁর মর্যাদার এক অনন্য নিদর্শন। নবীজির এই নির্দেশনা ছিল তাঁর প্রতি বিশেষ সম্মান ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি। এটি কেবল একটি পোশাকের হস্তান্তর ছিল না, বরং তা ছিল আধ্যাত্মিক ফায়েজ ও বরকতের এক সুদূরপ্রসারী ধারা, যা যুগযুগ ধরে মুসলিম উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং সুফি ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করেছে।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এঁর ওফাতের পর, তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী হজরত ওমর (রাদিআল্লাহু) এবং হযরত আলী (রাদিআল্লাহু আনহু) হজরত ওয়াইস আল-কারনীকে খুঁজতে শুরু করেন। প্রতি বছর হজের সময় ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু) ইয়েমেনের কাফেলাগুলোর কাছে ওয়াইসের খোঁজ নিতেন। অবশেষে নবীর ওফাতের পর একদা ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু) তাঁর খুতবায় ইয়েমেনের মানুষদের কাছে ওয়াইসের কথা জানতে চান। কয়েকজন মানুষ তাকে চিনতে পারলেও, ওয়াইসকে তারা ‘পাগল’ বা ‘অখ্যাত’ হিসেবেই জানতো।
ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু) ও আলী (রাদিআল্লাহু আনহু) ওয়াইসকে ইরাকের কুফা নগরীর ফোরাত নদীর তীরে বা কোনো নির্জন স্থানে পেলেন, যেখানে তিনি নামাজরত ছিলেন। তিনি যখন তাদের উপস্থিতি টের পেলেন, তখন নামাজ সংক্ষেপ করে সালাম ফেরালেন। তারা তাঁর হাতে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বর্ণিত সেই দীনার পরিমাণ সাদা দাগ দেখতে পেয়ে তাঁকে চিনতে পারেন। ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু) যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে সালাম জানালেন এবং উম্মতের জন্য দোয়ার আবেদন করলেন, তখন ওয়াইস বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন, “আপনারাই তো সব মুসলিমের জন্য দোয়া করার অধিক উপযুক্ত।” কিন্তু ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু) যখন নবীজির নির্দেশনার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন ওয়াইস দুহাত তুলে মোনাজাত করলেন, “আল্লাহুম্মাগফির লিল মুমিনিনা ওয়াল মু’মিনাত।” হে আল্লাহ, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের ক্ষমা করুন।
এই সাক্ষাৎকালে, ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশিত তাঁর পবিত্র চীরকা (মোটা পশমের পোশাক) হজরত ওয়াইস আল-কারনী রাদিআল্লাহু আনহুর হাতে তুলে দেন। হজরত ওয়াইস আল-কারনী এই চীরকা গ্রহণ করে আনন্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেজদা করেন এবং আল্লাহর কাছে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। (৫)
এই ঘটনাটি সুফিদের নিকট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার এবং নবুয়তি বরকতের হস্তান্তরকে নির্দেশ করে। উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) ওয়াইসের ছেঁড়া পোশাক আর দুনিয়াবিমুখতা দেখে এমনই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “যদি কেউ আমার কাছ থেকে এই খেলাফত (শাসনভার) এক রুটি দিয়ে কিনে নিত!” উত্তরে হজরত ওয়াইস আল-কারনী রাদিআল্লাহু আনহু বলেছিলেন, “হে উমর, বুদ্ধিহীন ব্যক্তি ছাড়া কেউ আপনার কাছ থেকে এটি কিনবে না। এটি ত্যাগ করুন, যে চায় সে নিক, কারণ এই স্থানে বেচা-কেনা চলে না।” ক্ষমতার এই চরম শিখরে দাঁড়িয়ে একজন ফকিরের এমন বাণী উমর (রাদিআল্লাহু আনহু)-এর মতো মহান শাসকের হৃদয়কেও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।
হজরত ওয়াইস আল-কারনী (রাদিআল্লাহু আনহু)-এঁর ইবাদত ছিল কল্পনাতীত। বর্ণিত আছে যে, তিনি সারা জীবন ঘুমাননি বা খুব কম ঘুমিয়েছেন। তাঁর রাতগুলো ছিল আল্লাহর সাথে একান্ত কথোপকথনের রাত। তিনি প্রতিটি রাতকে বিভিন্ন ইবাদতে ভাগ করে নিতেন। কোনো রাতে তিনি কিয়াম (দাঁড়িয়ে ইবাদত), কোনো রাতে রুকু (রুকুতে ইবাদত), আর কোনো রাতে সিজদা (সেজদায় ইবাদত) করতেন। তাঁর একটি সেজদা এতটাই দীর্ঘ হতো যে, একবার “সুবহা-না রাব্বিয়াল আ’লা” বলার পরই ফজর হয়ে যেত। তাঁর নামাজে একাগ্রতা ছিল অতুলনীয়; কথিত আছে, তাঁকে বর্শা দিয়ে আঘাত করলেও তিনি তা অনুভব করতেন না।
রাবেঈ’ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি হজরত ওয়াইস আল-কারনী রাদিআল্লাহু আনহুকে ফজরের নামাজে পাওয়ার পর লক্ষ্য করেন যে, তিনি চাশতের নামাজ পর্যন্ত তার স্থান থেকে ওঠেননি। এরপর জোহর, আসর, মাগরিব… এভাবে একটানা তিনদিন তিনি না ঘুমিয়ে, না খেয়ে ইবাদতে মগ্ন ছিলেন। চতুর্থ রাতে যখন সামান্য তন্দ্রা এলো, তিনি জেগে উঠে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে বেশি ঘুমানো চোখ এবং বেশি খাওয়া পেট থেকে আশ্রয় চাই।”
এই প্রার্থনা তাঁর আত্মিক সংগ্রামের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
তাঁর ক্ষুধা ছিল আল্লাহর জিকির, আর তাঁর তৃষ্ণা ছিল আল্লাহর প্রেম। তিনি দুনিয়ার সব মোহ ত্যাগ করেছিলেন। তিনদিন পর্যন্ত খাবার না পেয়েও তিনি কখনো অভিযোগ করতেন না, বরং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখতেন। আল্লাহও তাঁর জন্য গায়েবি সাহায্যের ব্যবস্থা করতেন। বর্ণিত আছে যে, একবার তিনদিন খাবার না পাওয়ার পর তিনি মাঠে একটি দীনার কুড়িয়ে পান, কিন্তু তা হয়তো কারো সম্পত্তি ভেবে ফেলে দেন। এরপর একটি ভেড়া মুখে করে একটি রুটি নিয়ে আসে, যা তিনি প্রথমে অন্যের সম্পদ ভেবে নিতে দ্বিধা করেন। তখন আল্লাহর ইচ্ছায় ভেড়াটি কথা বলে ওঠে, “হে ওয়াইস, আমি তার বান্দা যার তুমি বান্দা। আল্লাহ তোমাকে যে রিজিক দিয়েছেন, তা আল্লাহর বান্দার কাছ থেকে কেন নিচ্ছ না?” তারপর তিনি রুটিটি গ্রহণ করেন। তাঁর পোশাক ছিল সমাজের দরিদ্রতম মানুষের থেকেও নিচু মানের – আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ছেঁড়া কাপড় ধুয়ে সেলাই করে তিনি নিজের লজ্জাস্থান ঢাকতেন। অথচ এই আপাত সাধারণ চেহারার আড়ালেই প্রবাহিত হতো ‘রহমানের সুগন্ধ’। (৬)
আরও বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা ওয়াইসের আকৃতিতে হাজার ফেরেশতা সৃষ্টি করবেন এবং ওয়াইস তাদের সাথে হাশরের ময়দানে প্রবেশ করবেন। অতঃপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে বা তাকে দেখতে না পায়, তবে আল্লাহ যাকে চান সে ভিন্ন। কারণ তিনি দুনিয়াতে মানুষের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে, আত্মগোপনে আল্লাহর ইবাদত করেছেন। তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে পরকালে অন্যদের চোখ থেকে আড়াল করতে চেয়েছেন। যেমন তাঁর থেকে বর্ণিত আছে, “আমার অলিরা আমার তাঁবুর নিচে থাকে, আমাকে ছাড়া আর কেউ তাদের চিনে না।” (৭)
এই বর্ণনা ওয়াইসের গোপন ইবাদত ও আল্লাহ কর্তৃক তাঁর বিশেষ সুরক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করে। এটি যেন আল্লাহর এক অব্যক্ত প্রতিদান, লোকচক্ষুর অন্তরালে তাঁর ইবাদতের অনন্য পুরস্কার।
তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শন ছিল সরল; কিন্তু গভীর, প্রতিটি বাণী যেন আলোর দিশা। তেমনই কয়েকটি বাণী হলো—
“নিরাপত্তা একাকীত্বে।” এর অর্থ, দুনিয়ার কোলাহল ও মানুষের ভালোবাসার ভিড় থেকে অন্তরকে মুক্ত করে কেবল আল্লাহর স্মরণে নিবিষ্ট থাকা। এটি বাহ্যিক একাকীত্বের চেয়ে আত্মিক একাকীত্বের উপর জোর দেয়।
“তোমার অন্তরের যত্ন নাও।” অর্থাৎ, অন্তরের দরজাগুলো বন্ধ করে দাও, যাতে আল্লাহর স্মরণে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কোনো পরকীয়া বা দুনিয়ার মোহ প্রবেশ করতে না পারে।
“পাপের ক্ষুদ্রতার দিকে তাকাবে না, বরং আল্লাহর অবাধ্যতার বিশালতার দিকে তাকাবে।” এই বাণী মানুষকে ছোট পাপকেও হালকাভাবে না নিতে উৎসাহিত করে, কারণ প্রতিটি পাপই মহান আল্লাহর অবাধ্যতা।
“যে আল্লাহকে চেনে, তার কাছে কোনো কিছু গোপন থাকে না।” এর অর্থ, যখন বান্দা আল্লাহর মারিফাত (পরিচয়) লাভ করে, তখন দুনিয়ার সকল জটিল বিষয় তার কাছে সহজ হয়ে যায়।
“আমি শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজলাম, তা বিনয়ে পেলাম। নেতৃত্ব খুঁজলাম, তা সৃষ্টির উপদেশে পেলাম। গর্ব খুঁজলাম, তা দারিদ্র্যে পেলাম। সুন্নাহ খুঁজলাম, তা তাকওয়ায় পেলাম। সম্মান খুঁজলাম, তা কনাআতে (সন্তুষ্টি) পেলাম। আরাম খুঁজলাম, তা জুহদে (দুনিয়াত্যাগ) পেলাম।” এই উক্তিগুলো তাঁর জীবনের সারাংশ, তাঁর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির নির্যাস।
তিনি আরও বলেছেন, “যদি তুমি আল্লাহ তায়ালাকে আসমান ও জমিন পূর্ণ করে ইবাদত করো, তবুও তিনি কবুল করবেন না, যতক্ষণ না তুমি তাঁকে সত্য বলে জানো।” তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “কীভাবে তাঁকে সত্য বলে জানবে?” তিনি বললেন, “তিনি যা তোমার জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন, তাতে তুমি নিরাপদ থাকবে, আর তোমার অন্তর খালি হয়ে যাবে, যাতে তাঁর ইবাদত ছাড়া অন্য কিছুতে ব্যস্ত না হয়।”
তাঁর মতে, “যে তিনটি জিনিস ভালোবাসবে, জাহান্নাম তার জন্য শাহরগের চেয়েও নিকটবর্তী হয়ে যাবে। যথা, সুস্বাদু খাবার, মূল্যবান পোশাক এবং ধনীদের সাথে মেলামেশা।” এই উপদেশগুলো যেন দুনিয়াবী আকাঙ্ক্ষার বিপদ সম্পর্কে এক স্পষ্ট সতর্কবাণী। (৮)
হজরত ওয়াইস আল-কারনী (রাদিআল্লাহু আনহু)-এঁর ইনতিকাল সন নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু ভিন্নমত বিদ্যমান। তবে, অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য সূত্র এবং ঐতিহাসিকের মতে, তিনি ৩৭ হিজরি সনে (৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) সিফফিনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। এই যুদ্ধ ছিল হজরত আলী (রাদিআল্লাহু ) এবং মুয়াবিয়া (রাদিআল্লাহু আনহু)-এর মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ। ওয়াইস আল-করণী (রাদিআল্লাহু আনহু) যুদ্ধের ময়দানে হজরত আলী (রাদিআল্লাহু আনহু)-এঁর পক্ষে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহিদ হন। (৯)
হজরত ওয়াইস আল-কারনী (রাদিআল্লাহু আনহু) আজও এক নীরব কিংবদন্তি হিসেবে বেঁচে আছেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে, পার্থিব পরিচিতি বা সম্পদ নয়, বরং আল্লাহ ও তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি গভীর ভালোবাসা, অকৃত্রিম ভক্তি এবং নেক আমলই একজন মানুষকে অমর করে তোলে। তিনি যেন আজও তাঁর নিভৃত কুটির থেকে আমাদের কানে কানে বলে যাচ্ছেন – “হায়, পাথেয় কত কম, আর পথ কত দীর্ঘ!” এই বাণী আমাদের পার্থিব মোহের জাল ছিন্ন করে আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ করুক, এই হোক আমাদের প্রার্থনা।
তথ্যসূত্র:
১. মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১০৯৭৮
২. তাযকিরাতুল আউলিয়া, পৃ: ৪৩ মুহাম্মদ আল আসলি আল ওয়াসতানী শাফেঈ কর্তৃক আরবি অনূদিত,
৩. হিলয়াতুল আউলিয়া ২/৮০, তাযকিরাতুল আউলিয়া, পৃ: ৪২ মুহাম্মদ আল আসলি আল ওয়াসতানী শাফেঈ কর্তৃক আরবি অনূদিত,
৪. তাযকিরাতুল আউলিয়া পৃ: ৪৩-৪৪ মুহাম্মদ আল আসলি আল ওয়াসতানী শাফেঈ কর্তৃক আরবি অনূদিত,
৫.তাযকিরাতুল আউলিয়া পৃ: ৪৩, মুহাম্মদ আল আসলি আল ওয়াসতানী শাফেঈ কর্তৃক আরবি অনূদিত,
৬. তবাকাতুস সুফিয়্যাহ ১/২৮০
৭. ইমাম গাযালি, আল ইহইয়াউ উলুমিদ্বীন ৪/৩৪৮
৮. তাযকিরাতুল আউলিয়া, মুহাম্মদ আল আসলি আল ওয়াসতানী শাফেঈ কর্তৃক আরবি অনূদিত,
৯.তারিখে তাবারী, ইবনে আসাকিরের আত তারিখ।