উনিশ শতাব্দীর বিস্ময় গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.)

(১৮২৬ - ১৯০৬ )

গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) (১৪ জানুয়ারি ১৮২৬ – ২৩ জানুয়ারি ১৯০৬) দক্ষিণ এশিয়ার একজন প্রখ্যাত সুফিসাধক

Table of Contents

গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) (১৪ জানুয়ারি ১৮২৬ – ২৩ জানুয়ারি ১৯০৬) দক্ষিণ এশিয়ার একজন প্রখ্যাত সুফিসাধক এবং মাইজভান্ডারী তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুফি তরিকার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখো ভক্তের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁকে গাউসুল আজম, হজরত কেবলা, খাতেমুল অলদ, খাতেমুল আউলিয়া, শাঁই-এ-লিল্লাহ প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) ১৮২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি (১ মাঘ, ১২৩৩ বঙ্গাব্দ) চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল সৈয়দ মতিউল্লাহ মাইজভান্ডারী এবং মাতার নাম সৈয়দা খায়রুন্নেছা। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন সৈয়দ বংশের সদস্য এবং মদিনা থেকে বাগদাদ ও দিল্লি হয়ে মধ্যযুগীয় বাংলার গৌড়ে এসেছিলেন। তাঁর প্রপিতামহ সৈয়দ হামিদ উদ্দিন গৌড়ের ইমাম ও কাজী ছিলেন, কিন্তু মহামারীর কারণে তিনি চট্টগ্রামের পটিয়ায় চলে আসেন। এই বংশধারায় সৈয়দ আহমদ উল্লাহর পিতামহ সৈয়দ আবদুল কাদের ফটিকছড়ির আজিমনগরে ইমামতি করতেন। তাঁর পিতা সৈয়দ মতিউল্লাহ মাইজভাণ্ডার গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং সেখানেই সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এঁর জন্ম হয়। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল সৈয়দ আহমদ উল্লাহ, কিন্তু তাঁর ভক্তরা তাঁকে গাউসুল আজম (সর্বশ্রেষ্ঠ ত্রাণকর্তা) হিসেবে সম্মান করতেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের একটি গৌরবময় ইতিহাস ছিল, এবং তিনি এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি নিবিষ্ট হন।

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) ছিলেন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত। তিনি হাদিস, তাফসির, ফিকহ, মানতিক, হিকমত, বালাগত, উছুল, আকায়েদ, দর্শন এবং ফারায়েজের মতো বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি আরবি, উর্দু, বাংলা এবং ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তৎকালীন সময়ে তিনি একজন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ (ধর্মীয় বক্তা) হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। অল্প বয়সেই তিনি আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং সুফিসাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি কাদেরিয়া তরিকার প্রখ্যাত সুফিসাধক সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ সালেহ আল কাদেরী লাহোরী (ক.)—এঁর কাছে বায়াত গ্রহণ করেন এবং তাঁর নিকট থেকে বেলায়ত (আধ্যাত্মিক ক্ষমতা) অর্জন করেন। এ-ছাড়াও তিনি সৈয়দ দেলওয়ার আলী পাকবাজের কাছ থেকে এত্তাহাদি কুতুবিয়তের শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর কঠোর সাধনা ও ইবাদতের মাধ্যমে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছান, যা তাঁকে গাউসুল আজম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

১৮৫৭ সালে তাঁর পীরের নির্দেশে সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভাণ্ডারে ফিরে আসেন এবং ধীরে ধীরে তাঁর তরিকত চর্চার একটি রীতি হতে থাকে এবং তা পরবর্তীকালে মাইজভাণ্ডারী তরিকা নামে প্রতিষ্ঠা পায়। এটি কাদেরিয়া তরিকার একটি শাখা হলেও এতে চিশতিয়া এবং খিজিরি তরিকার উপাদানও যুক্ত হয়, যা এটিকে একটি যুগোপযোগী আধ্যাত্মিক পথ হিসেবে গড়ে তোলে। মাইজভান্ডারী তরিকা ইসলামের মৌলিক আদর্শের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে একটি উদার ও সর্বজনীন আধ্যাত্মিক দর্শন প্রচার করে। এই তরিকা মানবতা, ঐশী প্রেম এবং অসাম্প্রদায়িকতার উপর জোর দেয়। মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ, যা তাঁর বাসগৃহ থেকে শুরু হয়েছিল, কালক্রমে তা বিশ্ব মানবতার একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তাঁর শিষ্য ও ভক্তরা তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার বাণী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় ২০৪ জন খলিফার তালিকা পাওয়া যায়, যারা বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার এবং পাকিস্তানে তাঁর তরিকা প্রচার করেন।

১২৭৬ হিজরিতে (১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দ) ৩২ বছর বয়সে সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) আজিমনগরের মুন্সী সৈয়দ আফাজ উদ্দিন আহমদের কন্যা সৈয়দা আলফুন্নেছা বিবিকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে তাঁর স্ত্রী মারা যান। একই বছর তিনি পুনরায় সৈয়দা লুৎফুন্নেছা বিবিকে বিয়ে করেন। তাঁর প্রথম কন্যা সৈয়দা বদিউন্নেছা ১২৭৮ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু চার বছর বয়সে তিনিও মারা যান। এরপর তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করলেও তিনি অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ১২৮২ হিজরিতে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ ফয়জুল হক এবং ১২৮৯ হিজরিতে দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা আনোয়ারুন্নেছা জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর দ্বিতীয় পুত্রও তাঁর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন। তবে মৃত্যুর পূর্বে সৈয়দ ফয়জুল হক এঁর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারি রহ.। তিনিই গাউসুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)—এঁর বংশের একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচিত।

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)—এঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও কেরামত (অলৌকিক ঘটনা) সম্পর্কে বহু গ্রন্থে ও লোকমুখে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য কেরামতের মধ্যে রয়েছে—
১. মোহছেনিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা: তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাবে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ধর্মীয় শিক্ষার একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
২. মক্কা থেকে চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন: এক রাতে তিনি আধ্যাত্মিকভাবে মক্কা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন বলে কথিত আছে।
৩. হাজীর প্রত্যাবর্তন: তাঁর স্পর্শে একজন হাজী অলৌকিকভাবে তাঁর বাড়িতে ফিরে যান।
৪. প্রকৃতির উপর প্রভাব: তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্তরণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
৫. বাঘের কবল থেকে রক্ষা: এক ভক্ত একবার বনের মাঝে বাঘের কবলে পড়ে তাঁকে স্মরণ করলে তিনি দরবারের পুকুরে বদনা মেরে (যা বনের ঐ বাঘের মাথায় গিয়ে পড়ে) বনের বাঘ তাড়িয়ে দেন।

তাঁর সমসাময়িক ওলামা ও সুফি সাধকরা তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। মওলানা জুলফিকার আলী তাঁকে “সমস্ত অলিদের সর্দার” হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন, তাঁর নিঃশ্বাসের বরকতে পূর্বদেশের মানুষ খোদাপন্থী হয়েছে। তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর তরিকা লাখো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

তাঁর দরবারকে কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিক সংগীতের এক বিপ্লব সাধিত হয় মাইজভাণ্ডারী গানকে কেন্দ্রে করে। মাইজভাণ্ডারী গান হলো মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুসারীদের গাওয়া মরমী গান; যা আল্লাহ, নবী, অলি-আউলিয়াদের প্রশস্তি ও আধ্যাত্মিক ভক্তির কথা প্রকাশ করে। এই গানগুলো মূলত ঐশী প্রেম, মানবপ্রীতি, নৈতিকতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার উপর জোর দেয়। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এঁর আধ্যাত্মীয় মাহাত্ম্য এবং তাঁর তরিকার প্রভাব এই গানের মূল বিষয়বস্তু।

মাইজভাণ্ডারী গানের উৎপত্তি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, যখন সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এঁর ভক্তরা তাঁর শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার প্রশস্তি গাওয়া শুরু করেন। এই গানগুলো বাংলা লোকসংগীতের একটি ব্যতিক্রমী ধারা হিসেবে আবির্ভূত হয়; যা চট্টগ্রামের স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে একটি অনন্য রূপ লাভ করে। এই গানগুলো জিকির, ধ্যান এবং সেমা মাহফিলের অংশ হিসেবে গাওয়া হয়; যা মাইজভাণ্ডারী তরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিছু উল্লেখযোগ্য গান ও তাঁর প্রতি ভক্তির প্রকাশ নিম্নরূপ
১. “ইস্কুল খুইলাছে”
এই গানটি কবিয়াল রমেশ শীলের রচনা, যিনি মাইজভান্ডারী গানের একজন প্রখ্যাত গীতিকার। গানটির কথা হলো “ইস্কুল খুইলাছেরে মাওলা, ইস্কুল খুইলাছে
গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী ইস্কুল খুইলাছে।”
এই গানে গাউসুল আজমকে একজন আধ্যাত্মিক শিক্ষক এবং মাইজভাণ্ডার দরবারকে আধ্যাত্মিক শিক্ষার স্কুল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে সত্য ও প্রেমের পথ দেখান।
২. “ওকি চমৎকার ভান্ডারে এক আজব কারবার”
রমেশ শীলের আরেকটি বিখ্যাত গান, যেখানে মাইজভান্ডার দরবার শরীফকে একটি আধ্যাত্মিক ভান্ডার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এখানকার রীতিনীতি এক অদ্ভুত আবহে বিরাজিত হয় এমনটা বোঝানো হয়েছে।
৩. “আমার প্রাণে খোঁজে মাইজভান্ডার”
এই গানে ভক্তের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়, যেখানে তিনি গাউসুল আজমের দরবারে গিয়ে আধ্যাত্মিক শান্তি ও মুক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন, সেক্ষেত্রে তিনি নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা করেন না।
৪. “মজেছি তোমারই প্রেমে স্বর্গসুখ চাহি না।”
এই গানে জিকিরের মাধ্যমে গাউসুল আজমের প্রতি ভক্তি ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের কথা বর্ণিত হয় এবং এটি ছাড়া বেহেশতের সুখকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে। গানটি মাইজভাণ্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক চর্চার একটি অংশ, যা গাউসুল আজমের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

মাইজভাণ্ডারী গান ঐশী প্রেম ও আধ্যাত্মিক জাগরণের উপর জোর দেয়। এই গানগুলো ভক্তদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও গাউসুল আজমের প্রতি শ্রদ্ধা জাগায়। এই গানগুলো বাংলা লোকসংগীতের ধারায় রচিত, যা স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে একটি অনন্য রূপ লাভ করেছে। গানের ভাষা ও সুর সরল হলেও এর ভাব গভীর, যা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পণ্ডিত সকলের মন ছুঁয়ে যায়। মাইজভাণ্ডারী গান সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উন্মুক্ত, যা গাউসুল আজমের সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। মাইজভাণ্ডারী গানের সঙ্গে জড়িত কিছু বিখ্যাত গীতিকার হলেন— ১. রমেশ শীল, আবদুল হাদি কাঞ্চনপুরী, আবদুল গনী কাঞ্চনপুরী, বজলুল করিম মন্দাকিনী।

মাইজভাণ্ডারী তরিকার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য; যা গাউসুল আজমের জীবনদর্শনের প্রতিফলন ঘটায়।
১. জিকির ও ছেমা মাহফিল: এটি তরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে ভক্তরা গান, ধ্যান এবং দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে।
২. সিজদায়ে তাজিমি: এটি গাউসুল আজমের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের একটি রীতি, যা তাঁর আধ্যাত্মিক মর্যাদার প্রতীক।
৩. মানবিকতা ও সহনশীলতা: তাঁর তরিকা সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষকে একত্রিত করার উপর জোর দেয়।
৪. আধ্যাত্মিক শিক্ষা: তিনি মানুষকে ইসলামের মৌলিক আদর্শের সঙ্গে সুফি দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়ে জীবনযাপনের পথ দেখান।

এ ছাড়াও সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী রহ. এঁর প্রদর্শিত উসুলে সাবয়া তথা সপ্তকর্মপদ্ধতিকে মাইজভাণ্ডারী তরিকার সাধনার ধারা হিসাবে বর্ণনা করা হয়। সপ্তকর্মপদ্ধতি হলো—
ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তর:
১. ফানা আনিল খাল্ক: পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করা।
২. ফানা আনিল হাওয়া: অনর্থক কাজকর্ম ও কথাবার্তা হতে বিরত থাকা।
৩. ফানা আনিল এরাদা: নিজ ইচ্ছা বাসনাকে খোদার ইচ্ছায় বিলীন করে তাছলিম ও সন্তুষ্টি অর্জন করা।

মাউতে আরবা বা প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যু:
১. মউতে আবয়্যাজ বা সাদা মৃত্যু: উপবাস ও সংযমের মাধ্যমে অর্জিত এই মৃত্যুতে মানব মনে উজ্জ্বলতা ও আলো দেখা দেয়।
২. মউতে আছওয়াদ বা কালো মৃত্যু: সমালোচনায় বিরক্ত বা রাগান্বিত না হয়ে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজকে সংশোধনের মনমানসিকতা অর্জনই কালো মৃত্যু।
৩. মউতে আহমর বা লাল মৃত্যু: কামস্পৃহা ও লোভ-লালসা হতে মুক্তিতে হাসিল হয়।
৪. মউতে আখজার বা সবুজ মৃত্যু. নির্বিলাস জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে সবুজ মৃত্যু লাভ হয়।
এই সপ্তপদ্ধতি মানবজীবনের এক নিখুঁত সহজ, সরল ও স্বাভাবিক পন্থা; যা মানবজীবন পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন করে এবং মানুষকে ইনসানে কামেল হওয়ার পথে পরিপূর্ণভাবে ধাবিত করে।

এ ছাড়াও তাঁর কিছু রহস্যপূর্ণ বাণী মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। যথা-
১. কবুতরের মতো বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না, সন্তানসন্ততি লইয়া খোদার জিকির করো।
২. নিজের হাতে পাকাইয়া খাও, অন্যের হাতে পাকানো খাইও না।, আমি বারো মাস রোজা রাখি, তুমিও রোজা রাখিও।
৩. তোমরা ফাসাদ-বাহাস করিও না, তিনি মুসবি তরিকার লোক, খিজিরি কাজকারবার তিনি কী বুঝিবেন? আপন হালতে থাকিয়া যাও।
৪. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটি টুপির একটি আমার মাথায়, অপরটি আমার বড়ো ভাই গাউসুল আজম বড়পীর সাহেবের মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন।
৫. এইখানে আসিও না, এখানে হাওয়া দাফর হইয়াছে, ইহা বাবা আদমের কবর।

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এঁর ওফাতের পর প্রতি বছর ১০ মাঘ (জানুয়ারি মাসে) তাঁর স্মৃতিতে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে উরস শরিফ পালিত হয়। এই উৎসবে লাখো ভক্ত দেশ-বিদেশ থেকে সমবেত হন। উরসে খতমে কোরআন, নাতে মোস্তফা, শানে গাউছিয়া, জিকির, সেমা মাহফিল এবং মাইজভাণ্ডারী গান পরিবেশিত হয়। এই আয়োজনে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার করা হয়। তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গাউছুল আজম বিল বারাসত সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভাণ্ডারী এবং হজরত গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর পৌত্র সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীকে মনে করা হয়। এই দুইজনের বংশধররা বর্তমানে দরবারের গদিনসিন হিসাবে বিবেচিত হয়।

গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডরী ছিলেন একজন মহান সুফিসাধক, যিনি তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাইজভাণ্ডারী তরিকা আজও লাখো মানুষের জীবনকে আলোকিত করে চলেছে। মাইজভাণ্ডারী গান তাঁর জীবন ও শিক্ষার একটি জীবন্ত প্রকাশ, যা ভক্তদের মধ্যে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে ধরে রেখেছে। তাঁর জীবনী ও ম
রীতিনীতি আমাদের শেখায় যে, সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা মানুষকে বিভেদ ভুলে একত্রিত করে এবং ঐশী প্রেমের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধন করে। সবমিলিয়ে তিনি উনিশ শতাব্দীর এক বড়ো বিস্ময়।

গ্রন্থসূত্র:
১. গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জীবনী ও কেরামত, সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী।
২. সৈয়দ আহমদুল হক রচনাবলি, সৈয়দ আহমদুল হক।
৩. মাসিক জীবনবাতি
৪. মাসিক আলোকধারা
৫. অমৃতধারা, খাদেমুল হাসনাইন

Explore Our Beloved Sufis

Persian

শাহানশাহ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ছিলেন..

Persian

হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (১৮৬৫-১৯৩৭ খ্রি.), যিনি..

Persian

গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.)..

Persian

তাসাউফকে এককথায় ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। হজরত দাতা..

Persian

আল-হাসান আল-বসরীর উক্তিসমূহ: ১. “এই দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে..

Persian

ইসলামের ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁদের..

All Rights © SufiGraphy | Web Crafted by Sufi Media Solution (SMS).