গাউসুল আজম বিল বেরাসত হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী প্রকাশ বাবা ভাণ্ডারী (ক.)

(১৮৬৫-১৯৩৭)

হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (১৮৬৫-১৯৩৭ খ্রি.), যিনি ‘বাবা ভাণ্ডারী’ সুপরিচিত, মাইজভাণ্ডারী তরিকার একজন বিশিষ্ট সুফিসাধক এবং এই তরিকার দ্বিতীয়

Table of Contents

হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (১৮৬৫-১৯৩৭ খ্রি.), যিনি ‘বাবা ভাণ্ডারী’ সুপরিচিত, মাইজভাণ্ডারী তরিকার একজন বিশিষ্ট সুফিসাধক এবং এই তরিকার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর জীবন ও কর্ম ছিল ঐশী প্রেম, মানবতাবাদ এবং আধ্যাত্মিক সাধনার এক অপূর্ব সমন্বয়, যা মাইজভাণ্ডারী তরিকাকে উপমহাদেশে একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। তিনি ছিলেন মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রতিষ্ঠাতা গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর (ক.)—এঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং তাঁর অন্যতম আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী। তাঁর জীবন আধ্যাত্মিকতা, কোরআন-সুন্নাহর প্রতি অবিচল আনুগত্য এবং মানবকল্যাণের প্রতি নিবেদিত প্রাণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডারে সম্ভ্রান্ত এক সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সৈয়দ আবদুল করিম শাহ, যিনি মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমদ উল্লাহর ছোট ভাই। মাতা ছিলেন মোশারফ জান বিবি। তাঁর জন্মের পর যখন হজরত গাউসুল আজম আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)—এঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি নবজাতককে কোলে নিয়ে বলে উঠেন, “ইয়ে হামারে বাগকা গোলে গোলাব হ্যায়, হজরত ইউসুফ (আ.) কা চেহরা ইসমে আয়া হ্যায়। উসকো আজিজ রাখো, মায়নে উসকা নাম গোলামুর রহমান রাখা।” অর্থাৎ, এই ছেলে আমার বাগানের শ্রেষ্ঠ গোলাপ, হজরত ইউসুফ (আ.)—এঁর রূপ তাঁর মাঝে বিকশিত হয়েছে, তাঁকে যত্ন করবে, আমি তাঁর নাম গোলামুর রহমান রাখলাম।”

শৈশব থেকেই আধ্যাত্মিকতার প্রতি তাঁর গভীর ঝোঁক ছিল। তিনি প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি আরবি, ফার্সি, উর্দু এবং বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। তাঁর চাচা এবং আধ্যাত্মিক গুরু সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর নির্দেশনায় তিনি সুফি তরিকার গভীর জ্ঞান ও সাধনায় নিমগ্ন হন। তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষার মূল ভিত্তি ছিল কোরআন, হাদিস এবং ইসলামি মানবতাবাদী দর্শন। তিনি তাঁর চাচার প্রধান খলিফা এবং পরবর্তীতে মাইজভাণ্ডারী দরবারের সাজ্জাদানশীন (আধ্যাত্মিক নেতা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়ে মাইজভাণ্ডারী তরিকা বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে ভারত, পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা ছিল গভীর এবং বহুমুখী। তাঁর দর্শন ছিল ঐশী প্রেমবাদ ও মানবতাবাদী দর্শন, যেখানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করাই ছিল মূল লক্ষ্য।

তাঁর সাধনার জীবন বৈচিত্র্যময়। ছাত্রজীবন থেকেই এই পথে নিজেকে পরিচালিত করেছেন। দিনে একাধারে রোজা রাখতেন, রাতজেগে নামাজে কাটাতেন চট্টগ্রাম শহরের বহরদার বাড়ি জামে মসজিদে। মাদরাসায় অধ্যয়নের শেষের দিকে (জামায়াতে উলা পরীক্ষার আগে) হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) তাঁকে আধ্যাত্মিক আমানতের স্বীকৃতি হিসেবে জোব্বা পরিয়ে দেন। এর পরও তিনি দীর্ঘ বারো বছর বন-জঙ্গলে সাধনরত অবস্থায় কাটিয়ে নিজের ‘মকাম’কে আরো উন্নীত করতে থাকেন। এর মাঝে অবশ্য তিনি মাঝেমধ্যে দরবারে আসতেন, কিন্তু বেশিদিন অবস্থান করতেন না। সবার অজান্তে হুট করে একদিন বেরিয়ে পড়তেন। আল্লামা ইকবাল যেমনটি বলেছিলেন,
“খুদি কো কর বুলন্দ ইতনা কে হর তাকদির ছে পেহলে
খোদা বান্দেছে খোদ পুঁছে বাতা তেরি রাজা কিয়া হ্যায়!”
অর্থাৎ,
আপন সত্ত্বাকে এতটা উপরে নিয়ে যাও, যেন প্রতিবার ভাগ্য লেখার আগে খোদা তোমাকেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘বলো, প্রিয়, তোমার চাওয়া কী?’

সাধনা শেষে তিনি মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে ফিরে আসেন, ততদিনে অবশ্য হজরত কেবলা (ক.) ইন্তেকাল করেছেন। তাঁকে পুনরায় দরবারে নিয়ে আসার জন্য হজরত কেবলা (ক.) তাঁর অন্যতম খলিফা আবদুল হাদি কাঞ্চনপুরী (রহ.) পাঠিয়েছিলেন। এই নিয়ে আবদুল হাদি কাঞ্চনপুরী একটি গানও রচনা করেন—
পায় পড়ি মিনতি করি হে প্রাণ তোমায়
গাউছ ধন তোমায় নিতে পাঠাইয়াছেন রায়॥
পায়ে না ঠেলিও মোরে, প্রিয়ে এবে চল ঘরে
সিংহাসন ছেড়ে কেনে আসিলেন হেথায়॥
আঁখির পুতলি করে নিব প্রিয়া প্রেমাদরে
মাইজভাণ্ডারের সিংহাসনে বসাব তোমায়॥
পুষ্প বিনে অলিকুল, কেঁদে হ’ল ব্যাকুল
তুমি বিনে দাস হাদীর প্রাণ যে যায়॥

প্রেমমাখা এই গান শুনে হজরত বাবা ভাণ্ডারী (ক.) মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে ফেরত আসার জন্য মনস্থির করেন, অপরদিকে তাঁর প্রিয়তম মুর্শিদ ইন্তেকাল করেন। এই বিচ্ছেদ যাতনা সহ্য করতে পারবে না জেনে তিনি তৎক্ষণাৎ দরবারে ফেরত আসেননি বলে অনেকেই মনে করেন। যার কারণে তাঁকে জানাযার সময় দেখা যায়নি। অবশেষে যখন তিনি ফিরে তখন হজরত কেবলা (ক.)—এঁর খলিফা ভক্ত-আশেকগণ তাঁর কদমে গিয়ে আশ্রয় নেন। অর্থাৎ, মাইজভাণ্ডার দরবারের দ্বিতীয় প্রধান আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার হিসেবে সবাই তাঁকে গ্রহণ করে নেন।

মাইজভাণ্ডারী তরিকার দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভাণ্ডারী (ক.) এই তরিকার প্রসার ও জনপ্রিয়তায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর সময়ে এই তরিকা লক্ষ লক্ষ ভক্তের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তাঁর চাচা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.)—এঁর প্রতিষ্ঠিত তরিকার মূলনীতি—কাদেরি, চিশতি এবং খিজির তরিকার সমন্বয়কে আরও শক্তিশালী করেন। তাঁর নেতৃত্বে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ একটি আধ্যাত্মিক ও সামাজিক কেন্দ্রে পরিণত হয়, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলনমেলা বসে। তাঁর রওজা শরীফ আজও লাখো ভক্তের তীর্থস্থান। তাঁর সময়ে এসে মাইজভাণ্ডারী গান বাংলার সুফিসংস্কৃতিতে আরও ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিখ্যাত রমেশ শীল মাইজভাণ্ডার শরিফে এসে তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়েই গান লেখা শুরু করেন। এবং এ সময়েই মাইজভাণ্ডারী গানে জলসা তথা সেমা মাহফিল চূড়ান্তভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

তাঁর অসংখ্য কারামতের কথা বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে সংরক্ষিত আছে, লোকমুখেও এসমস্ত কারামত বহুকাল যাবত প্রচারিত। পাহাড়-পর্বতে সাধনরত অবস্থায় তাঁর সাথে মাঝে মাঝে অনেকের সাক্ষাৎ ঘটে যেত। এবং তাঁকে একবার দেখতে পেলে কেউ কেউ সাহস করে তাঁকে অনুসরণ করে দায়া প্রাপ্তির আশায় পিছু নিত। তাঁদের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি গভীর অরণ্যে হাঁটলেও তাঁর জন্য আপনাআপনি পথ তৈরি হয়ে যেত, বনের হিংস্র জন্তুরা এসে পায়ে চুমু খেয়ে যেত। অর্থাৎ, সৃষ্টির সবকিছু তাঁকে শ্রদ্ধা করতো, তাঁর কাজের সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করতো। তাঁর হাতছোঁয়া পানির বরকতে বহু লোকের মরণাপন্ন জীবন ফেরত পাওয়ার নজির আছে। এ ছাড়াও বিপদকালে তাঁকে স্মরণ করার মাধ্যমে তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় বহু লোকের বিপদ তাৎক্ষণিক কেটে যাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটেছে। তাঁর কারামত হিসেবে একটি ঘটনা খুবই প্রসিদ্ধ। তা হচ্ছে, এক লোক কিমিয়াগিরদের ফাঁদে পড়ে তামাকে স্বর্ণ বানানোর চেষ্টার বহুদিন যাবত কসরত করতে থাকে। শেষমেশ বাবা ভাণ্ডারীর কাছে গিয়ে এই বিদ্যা শেখানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু বাবা ভাণ্ডারী লোভ ত্যাগ করতে তাকে বারবার পরামর্শ দেন। কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা দেখে বাবা ভাণ্ডারী তার হাতে কিছু পাতা দেন। বলেন, তামা গরম করে এই পাতার রস তাঁর উপর ঢেলে দাও। লোকটি দ্রুত তামা গরম করে তার উপর ঐ পাতার রস ঢেলে দিলে তামা তৎক্ষণাৎ সোনায় রূপান্তর হয়ে যায়। এবার লোকটি খুশিমনে নিজের বাড়ির রাস্তা ধরে এবং যাবার বেলায় একই রকম পাতা বন থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। বাড়ি গিয়ে অনেক চেষ্টার পরও তার সে চেষ্টা সফল হয় না। অবশেষে বাবা ভাণ্ডারীর কাছে এসে ঘটনা বর্ণনা করলে বাব ভাণ্ডারী (ক.) বলেন, “পাতা দ্বারা সোনা হয় না, জবান দ্বারা সোনা হয়।”

প্রতি বছর ২২ চৈত্র (৫ এপ্রিল) হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভাণ্ডারী (ক.) এঁর বার্ষিক ওরস শরিফ মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে মহাসমারোহে পালিত হয়। অর্থাৎ, এই দিনেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এই ওরসে দেশ-বিদেশ থেকে লাখো ভক্ত সমবেত হন। ওরসের প্রধান আকর্ষণ হলো— মিলাদ কিয়াম, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, সেমা মাহফিল ও আখেরি মুনাজাত, যেখানে বিশ্বের শান্তি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনা করা হয়। তাঁর রওজা শরিফে গিলাফ চড়ানো এবং জিয়ারতের মাধ্যমে ভক্তরা তাঁর ফয়েজ লাভের আশা করেন।

সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভাণ্ডারী শুধু একজন আধ্যাত্মিক নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সামাজিক সংস্কারক। তাঁর সময়ে মাইজভাণ্ডারী তরিকা মানবতাবাদী দর্শনের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়েছিল। তাঁর জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি জসীমউদ্দিনের মতো কবিরা তাঁকে নিয়ে রচনা লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর উপাধি “গাউসুল আজম বিল বেরাসত” এবং “বাবা ভাণ্ডারী” তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ও ভক্তদের প্রতি তাঁর অপার করুণার প্রতীক। তিনি ছিলেন একজন মহান সুফিসাধক, যাঁর জীবন ও শিক্ষা বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এক অমর অধ্যায়। তাঁর ঐশী প্রেম, মানবতাবাদী দর্শন এবং কোরআন-সুন্নাহর প্রতি নিষ্ঠা তাঁকে লাখো ভক্তের হৃদয়ে অমর করে রেখেছে।

Explore Our Beloved Sufis

Persian

শাহানশাহ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ছিলেন..

Persian

হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (১৮৬৫-১৯৩৭ খ্রি.), যিনি..

Persian

গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.)..

Persian

তাসাউফকে এককথায় ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। হজরত দাতা..

Persian

আল-হাসান আল-বসরীর উক্তিসমূহ: ১. “এই দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে..

Persian

ইসলামের ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁদের..

All Rights © SufiGraphy | Web Crafted by Sufi Media Solution (SMS).