তাসাউফ: আত্মশুদ্ধির পথ

তাসাউফকে এককথায় ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। হজরত দাতা গঞ্জে বখশ লাহোরি, যিনি খাজা গরিবে নেওয়াজের প্রায় দেড়শ বছর আগে ভারতবর্ষে

Table of Contents

তাসাউফকে এককথায় ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। হজরত দাতা গঞ্জে বখশ লাহোরি, যিনি খাজা গরিবে নেওয়াজের প্রায় দেড়শ বছর আগে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, তাঁর বিখ্যাত কিতাব ‘কাশফুল মাহজুব’—এ ইমাম হোসাইনের নাতি মুহাম্মদ ইবনে আলির সূত্রে এসেছে, “তাসাউফ হচ্ছে উত্তম চরিত্র। অতএব যার চরিত্র যত উন্নত হবে তার তাসাউফও তত বৃদ্ধি পাবে।”

এই চরিত্রের অবশ্য দুটি ধাপ আছে। প্রথমত স্রষ্টার সাথে সদ্‌ব্যবহার, দ্বিতীয়ত সৃষ্টির প্রতি সদ্‌ব্যবহার। স্রষ্টার সাথে সদ্‌ব্যবহারের অর্থ হচ্ছে, বান্দা আল্লাহর সমস্ত আইনকানুনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। তাঁর কোনো কাজে অভিযোগ করবে না৷ সকল আদেশ-নিষেধ অবনত মস্তকে মেনে নেবে। আর সৃষ্টির প্রতি সদ্‌ব্যবহারের অর্থ হলো, সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ তায়ালা যে দায়িত্ব দিয়েছেন, নিঃস্বার্থভাবে সে দায়িত্ব পালন করা। অবশ্য এটি কোনো প্রকার বাড়তি আকাঙ্ক্ষা না রেখে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে৷

তাসাউফের সংজ্ঞায় বিভিন্ন মনীষীর বক্তব্য হলো—
১. ইমাম আল-জুনায়দ আল-বাগদাদী (রহ.) বলেন—
> التصوف هو أن تكون مع الله بلا علاقة
তাসাউফ হলো, কোনো পার্থিব স্বার্থ বা লেনদেন ছাড়া আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা।
(ইমাম কুশাইরী, “আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ”, পৃষ্ঠা ৫৮
আবু আবদুর রহমান সুলামী, “তাবাকাতুস সুফিয়্যাহ”)

২. শায়খ আবূ বাকর আল-কতান (রহ.) বলেন—
> التصوف خلق، فمن زاد عليك في الخلق، زاد عليك في التصوف.
তাসাউফ হলো চরিত্র। যে ব্যক্তি নৈতিক গুণাবলিতে তোমার চেয়ে অগ্রগামী, সে-ই তাসাউফে তোমার চেয়ে অগ্রগামী।
(কুশাইরী, “আর-রিসালা”, পৃষ্ঠা ৬১
ইবনুল জাওযী, “সিফাতুস সফওয়াহ”, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৭৫)

৩. ইমাম আল-গাযযালী (রহ.) বলেন—
> التصوف هو علم يُعرف به كيفية السلوك إلى حضرة ربّ العالمين، وتصفية الباطن من الرذائل وتحليته بالفضائل.
তাসাউফ এমন এক জ্ঞান, যার মাধ্যমে কীভাবে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছাতে হয়, তা জানা যায়; এটি অন্তরকে নিকৃষ্টতা থেকে পরিশোধন করে এবং মহৎ গুণাবলি দ্বারা সুশোভিত করে।
(ইমাম গাযযালী, “ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন”, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪
“আল-মুনকিযু মিন আদ-দালাল”)

৫. শায়খ আহমদ জামী (রহ.) বলেন—
> التصوف كله أدب، فكل وقت له أدب، وكل حال له أدب، وكل مقام له أدب.
তাসাউফ পুরোটাই শিষ্টাচার। প্রতিটি সময়ের, অবস্থার ও পর্যায়ের একটি করে শিষ্টাচার রয়েছে।
(আবদুর রহমান আল-জামী, “নাফাহাতুল উনস”, পৃষ্ঠা ৪১)

৬. ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) বলেন,
التصوف هو العمل على تزكية النفس وتصفية القلب، وترك التعلق بغير الله.
তাসাউফ হলো— আত্মার পরিশুদ্ধি, অন্তরের পরিচ্ছন্নতা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যকিছুর প্রতি আকর্ষণ পরিহার করা।
(শাহ ওয়ালিউল্লাহ, “আল-কাওলুল জামীল”, পৃষ্ঠা ১২
“হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা”, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১১৫)

এই মনীষীদের সংজ্ঞাগুলো থেকে বোঝা যায়, তাসাউফ মূলত আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা, নৈতিক উৎকর্ষ ও দুনিয়ার মোহ থেকে বিমুক্ত হওয়া— এই চারটি মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

দাতা গঞ্জে বখশ কাশফুল মাহজুবে হজরত জোনায়েদ বোগদাদির ভাষ্যও এনেছেন। জোনায়েদ বোগদাদির মতে তাসাউফের নিদর্শন আট রকম।
১. সাখা-উ তথা সর্বোতভাবেই উৎসর্গ করা। এর উদাহরণ রয়েছে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জীবনে৷ তিনি তাঁর নিজের এবং পুত্রের জান পর্যন্ত আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন।
২. রেজা তথা সন্তুষ্টি। এটার উদাহরণ ইসমাইল আলাইহিস সালামের জীবনে। তিনি যখন জানতে পারলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর জান দেবার রায় এসেছে, তখন তিনি নিঃসংকোচে মেনে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন।
৩. সবর তথা ধৈর্য। এর উদাহরণ আইয়ুব আলাইহিস সালামের জীবনে রয়েছে। চোখের সামনে নিজের পরিবারের সবাইকে ছেড়ে যেতে দেখে এবং নিজের সমস্ত শরীর পোকায় খেয়ে ফেলার পরও তিনি অধৈর্য হননি।
৪. ইশারা তথা জবানের হেফাজতের লক্ষ্যে মৌনতা অবলম্বন করে কেবল ইঙ্গিতের মাধ্যমে কাজ করা। এর উদাহরণ পাওয়া যায় জাকারিয়া আলাইহিস সালামের জীবনে। তিনি আল্লাহর আদেশ পালন করতে গিয়ে কথা বলা বন্ধ করে ইশারার প্রতি নিবিষ্ট হয়েছিলেন।
৫. গুরবাত তথা নিজের শানশওকত বা মর্যাদা লুকানোর চেষ্টা। এর উদাহরণ রয়েছে ইয়াহিয়া আলাইহিস সালামের জীবনে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ দেশের লোকেরাও তাঁকে চিনতে পারেনি ঠিকঠাক।
৬. পশমি পোশাক পরা। মুসা আলাইহিস সালাম পশমি পোশাক পরতে পছন্দ করতেন।
৭. সিয়াহাত তথা সফর করা। ইসা আলাইহিস সালামের জীবন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি কেবল একটি পানির বোতল এবং একটি চিরুনি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু পথে যখন দেখলেন এক ব্যক্তি আঙুল দিয়ে চুল সিঁথি করছেন এবং হাতের তালু ভরে পানি পান করছেন, তখন নিজের পানির বোতল এবং চিরুনিও ফেলে দিলেন। একমাত্র আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা নিয়ে রওনা হলেন।
৮. ফকিরি তথা দরিদ্রতাকে গ্রহণ করা। এর উদাহরণ আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাতে সব ধনভান্ডারের চাবি দিয়ে দিয়েছেন। তিনি চাইলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন একদিন পেট ভরে খাওয়া আর দুদিন রোজা রাখাকে। সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সম্পদের যথেচ্ছা ব্যবহার এবং সম্পদে ডুবে যাওয়া থেকে তিনি নিজেকে পরিপূর্ণ মুক্ত করেছিলেন। বেছে নিয়েছেন ফকিরি৷ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলতেন, হে আল্লাহ, আপনি আমাকে দারিদ্র্য অবস্থায় জীবিত রাখুন, দারিদ্র্য অবস্থায় ইন্তেকাল করান এবং দারিদ্র্য অবস্থায় হাশর করার তাওফিক দান করুন।

তাসাউফ মূলত ইসলামের রুহ। কারণ, এটি রুহানিয়ত চর্চাকে সর্বোতভাবে প্রাধান্য দেয়। এখানে বাহ্যিক বিষয়-আশয়কে প্রাধান্য না দিয়ে আত্মিক বা আধ্যাত্মিক দিককেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। শায়খুল মাশায়েখ আবদুল কাদের জিলানি (রা.) তাসাউফের আরও গূঢ়ার্থ প্রধান করেছেন সিররুল আসরার কিতাবে। তিনি আরবি তাসাউ্উফ শব্দের মাধ্যমে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন।

তাঁর মতে, তাসাউ্উফে শব্দের ‘তা’ বর্ণের অর্থ হচ্ছে তওবা। এটার ধরন দুটি। জাহেরি ও বাতেনি। জাহেরি তওবা হচ্ছে কথায়-কাজে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা। শরিয়তের বিষয়াবলির যথাযথ অনুসরণ করা এবং কোনো বিধানের বিরোধিতা না করা। যদিও কোনো বিধানের লঙ্ঘন হয়ে যায় তবে দ্রুত তওবা করে নেওয়া। আর বাতেনি তওবা হচ্ছে হৃদয়ের সকল কলুষতা দূর করে হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে তোলার মাধ্যমে শরিয়তের বিধিনিষেধ যথাযথ মেনে চলার উপর অটল অবস্থা সৃষ্টি করা। এভাবে একসময় ‘তা’ এর স্তর পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তখনই বান্দার তওবা তওবাতুন নাসুহাহ তথা কবুলকৃত তওবা হিসেবে গণ্য হয়। এর পর আসে ‘ছোয়াদ’ এর স্তর।

‘ছোয়াদ’ অর্থ হচ্ছে সোয়াফা তথা পবিত্রতা। এটাও দ্বি-স্তর বিশিষ্ট। কলবের পবিত্রতা এবং লতিফায়ে সির—এর পবিত্রতা। কলবের পবিত্রতা হলো কলবকে মানবীয় দুর্বলতা থেকে পবিত্র করা। অর্থাৎ, পানাহার, শয়ন, বলা এবং শোনার ইচ্ছা। এ ছাড়াও পার্থিব জিনিসের প্রতি আসক্তি, যেমন বাণিজ্যের সমৃদ্ধি, বিলাসিতা, প্রবৃত্তির তাড়নায় অধিক সঙ্গম, পরিবার-পরিজনের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা প্রকাশ ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকা। উল্লেখ্য যে, এসব থেকে বাঁচতে প্রথমত কামেল পীরের নির্দেশনায় উচ্চস্বরে জিকির করাকে অপরিহার্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। উচ্চস্বরে জিকির করতে করতে এক সময় লতিফায়ে সিররে গোপন জিকির জারি হয়ে যায়। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “পরিপূর্ণ ইমানদার তাঁরাই, যাঁদের সামনে জিকির করা হলে তাদের কলব প্রকম্পিত হতে থাকে।” (সুরা আনফাল, আয়াত ২)

বলাবাহুল্য, অন্তর তখনই প্রকম্পিত হয়, যখন আল্লাহর মহত্ত্বের ভয়ে অন্তর উদাসিনতা মুক্ত ও সজাগ থাকে৷, তখন হৃদয়ের দর্পণ ইবাদত ও সাধনার রঙে এমনভাবে রঙিন হয়ে উঠে যে, তাতে ভালো-মন্দের পার্থক্য অদৃশ্য এক আলোকছটার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন, নবীজি বলেছেন, আল আ-লিমু ইউনাক্কিশু, ওয়াল আ-রিফু ইউছক্কিলু। অর্থাৎ, আলেমরা ভালো-মন্দের তফাৎ দেখিয়ে দেন আর আরিফরা (খোদার পরিচয়প্রাপ্ত) অন্তরের মন্দটা পরিষ্কার করে দেন। লতিফায়ে সির এর পবিত্রতা হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে তাঁর প্রেমে উন্মুখ হয়ে যাওয়া। এটি আল্লাহর নামসমূহের গোপন জিকির স্থায়ীভাবে জারি করার মাধ্যমে অর্জিত হয়৷ আর মানুষ যখন এই গুণ অর্জন করে ফেলেন, তখন তাঁর মাঝে ছোয়াদ এর মকাম পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

‘ওয়াও’ অর্থ হচ্ছে ওয়িলায়ত বা বেলায়ত। এটি একটি মকাম, যা আত্মার পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে অর্জিত হয়৷ যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর অলিদের কোনো ভয় নেই এবং তাঁদের কোনো চিন্তাও নাই।” (সুরা ইউনুস, আয়াত ৬২)। বেলায়তের ফল হচ্ছে মানুষের মাঝে আল্লাহর গুণাবলির বিকাশ ঘটা। যেমন, নবীজি বলেছেন, তাখাল্লাকু বি-আখলা-কিল্লাহ। তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও। এর অর্থ হচ্ছে মানবীয় পোশাক ত্যাগ করে আল্লাহর গুণাবলির পোশাক গ্রহণ করা। যেমন হাদিসে কুদসিতে এসেছে, “যখন আমি কোনো বান্দাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কান, চোখ, জবান, হাত-পা হয়ে যাই। অতঃপর সে আমার দেওয়া ক্ষমতাতেই দেখে, শোনে, বলে, ধরে এবং চলাফেরা করে।” (বুখারি শরিফ, হাদিস ৬৫০২)।
আর মানুষ যখন বস্তুবাদের উর্ধ্বে গিয়ে রুহানিয়তকে পবিত্র করে নিবে, তখন কেবল সত্য এবং ন্যায়-ই দেখতে থাকবে। অসত্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “হে রসুল, আপনি বলে দিন, সত্য এসেছে, মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে, নিশ্চিত মিথ্যা বিলুপ্তা হবারই ছিল।” (সুরা বনি ইসরাইন, আয়াত ৮১)। আর এভাবেই ‘ওয়াও’ এর মকাম অর্জিত হয়।

এরপর বাকি থাকে ‘ফা’। যার দ্বারা উদ্দেশ্য ‘ফানা’ তথা ফানাফিল্লাহ। উপর্যুক্ত সাধনার মাধ্যমে যখন বান্দা যাবতীয় মানবীয় গুণাবলি অতিক্রম করে, তখন তাঁর মাঝে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলি এসে ভর করে। আর আল্লাহর এই গুণাবলির ক্ষয় ও ধ্বংস নাই। কেননা তিনি চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব। অতএব, আত্মবিলুপ্ত বান্দা তাঁর রবের চিরস্থায়ী সত্তা ও সন্তুষ্টিতে স্থায়ী হয়ে যাবে। অর্থাৎ, তাঁর মাধ্যমে কেবল আল্লাহ প্রদত্ত গুণাবলিই প্রকাশিত হবে। বিলুপ্ত হওয়া এই রুহ অদৃশ্য সত্তা ও তাঁর কুদরতি দৃষ্টিতে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। যেমন, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সব ধ্বংসশীল।” (সুরা কাসাস, আয়াত ৮৮)। অর্থাৎ, বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে যাবতীয় সৎকাজের মাধ্যমে আল্লাহর রেজায়ি তথা সন্তুষ্টির মকামে পৌঁছে যাবে, তখন সে তাঁর প্রভুর সত্তা ও সন্তুষ্টিতে বেঁচে থাকবে।

সবমিলিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীতে মানুষের জীবনে সৎকাজের হাকিকত হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনার জগতে সে একজন শিশু। তাই তাসাউফকে এক কথায় ব্যাখ্যা করা বেশ মুশকিল। সব কথার মোদ্দা হচ্ছে তাসাউফ প্রথমত সংশোধনের পথ, দ্বিতীয়ত আত্ম-উন্নয়ন তথা আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ, তৃতীয় আল্লাহ পাওয়ার পথ। প্রথমত শরিয়তের বিধানগুলো যথাযথ পালন করতে হবে৷ আর বিধিবিধান পালন করার জন্য যেটুকু জ্ঞান অর্জন দরকার সেটুকু অবশ্যই জেনে নিতে হবে। একইসাথে যাবতীয় পাপাচার থেকে তওবা করে একনিষ্ঠভাবে পাপ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যেতে হবে। এটার মাধ্যমে আপনি প্রথম ধাপ তথা সংশোধন হতে পারবেন। সংশোধনের এ ধারা অব্যাহত রেখে আরও বেশি বেশি ইবাদত-রিয়াজতের মাধ্যমে আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটতে থাকবে৷ এভাবে উন্নতি ঘটতে ঘটতে একসময় আপনি খোদার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। যাঁদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “সাবধান, নিশ্চয় আল্লাহর অলিদের কোনো ভয় নাই, তাঁরা পেরেশানিতেও পড়বে না।” সুতরাং, বলা যায় যে, মিথ্যাবাদির জন্য মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকাই তাসাউফ, বেনামাজির জন্য নামাজি হয়ে উঠা তাসাউফ, সুদখোরের জন্য সুদ থেকে ফিরে আসা তাসাউফ। এভাবে প্রতিটি চারিত্রিক উন্নতি এবং ভালো কাজের যাত্রাই তাসাউফ। যার মাধ্যমে বান্দা ধীরে ধীরে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে পারে৷

তবে এই একজন গাইড অত্যাবশ্যক। গাইডকে অবশ্য ফার্সিতে পীর বলে। আরবিতে বলে মুর্শিদ, শায়খ। হক্কানি পীরের অনুসন্ধান করে তাঁর দেওয়া রীতিনীতি অনুযায়ী চর্চা করলে আল্লাহ নিশ্চয় পথ দেখাবেন।

তবে মুরশিদ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ইমাম গাজালির ‘মিনহাজুল আবেদিন’কে গাইড হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। এটিকে তাঁর এহইয়া-ই-উলুমুদ্দিন কিংবা কিমিয়ায়ে সা’দাত গ্রন্থের সার বলা চলে। এই বইটি আল্লাহর পথের পথিকদের জন্য অনবদ্য এক গাইডলাইন। ইমাম গাজালির আগে সম্ভবত আর কেউ-ই এমন ধারাবাহিক সাধনার ফিরিস্তি বই আকারে আনার চেষ্টা করেননি। বইতে তিনি প্রথমে যে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটা আল্লাহর প্রেরিত প্রথম বাণী ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল-লাজি খালাক’কে স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ, তিনি শুরুতেই গুরুত্বারোপ করেছেন জ্ঞানার্জনের প্রতি। বান্দা যে বিষয়ে আমল করবে, সে বিষয়টা যেন আগে পুরোপুরি জেনে নেয়, যাতে তাঁর ইবাদত নষ্ট না হয়। কলুর বলদ যেমন ভারবহন করেও ফল পায় না তেমন যেন না ঘটে— এজন্য ইমান গাজালি প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন, তওবার কথা। কারণ, আল্লাহর পথে যাত্রাকারীদের শয়তান নানানভাবে নানান পাপাচারে প্রলুব্ধ করে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। তাই সবার প্রথমে যাবতীয় পাপাচার থেকে ফেরত আসা এবং পুনরায় পাপাচারে লিপ্ত না হওয়ার জন্য তওবার প্রয়োজন। হক্কানি পীরদের বৈশিষ্ট্যও এটি। তাঁরা কাউকে মুরিদ করার আগে তওবা পড়ান।

এরপরে আলোচনা করেছেন মাখলুখ নিয়ে। মাখলুকের দাসত্ব থেকে সরে এসে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার বাস্তবিক ধরন দেখানো হয়েছে এখানে। আপনি সবার সাথে থেকেও যেন একান্ত আল্লাহর, আপনার ধ্যানজ্ঞান যেন সর্বদা তাঁর দিকেই নিবিষ্ট থাকে, এই হালত অর্জন করার পথ দেখানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বড়োপীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) এঁর বাণী রয়েছে। তিনি বলেছেন, “মুমিন মুখের হাসি দিয়ে মনের দুঃখ লোকায়। সে বাইরে উপার্জনের কাজ করে, ভেতরে আল্লাহর সান্নিধ্যে মগ্ন থাকে। তার দেহ পরিবার পরিজনের জন্য, আত্মা পরওয়ারদিগারের জন্য। এ রহস্য পরিবার, সন্তান, পড়শি, এমনকি সৃষ্টিকুলের কেউ-ই জানে না।”

অতঃপর আলোচনা হয়েছে নফসে আম্মারাকে কীভাবে দমন করা যাবে, কীভাবে নফসের খায়েশ থেকে বেঁচে নফসে মুসমাইন্নাতে উন্নীত হবে। এটার পরপরই এসেছে পেটের হেফাজতের কথা। পেটকে হারাম মুক্ত করার কার্যকরী উপায় এবং উপকারিতা বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এ অধ্যায়ে। দুনিয়া, সৃষ্টজীব, শয়তান ও নফসের ধোঁকা থেকে বাঁচার ফর্মুলা এসেছে এর পরের অধ্যায়ে। এসবের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে এসবের ভেতরকার বিপদ এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় খুব সাবলীলভাবে উঠে এসেছে অধ্যায়গুলোতে। সপ্তম, অষ্টম, নবম অধ্যায়ে এসেছে যথাক্রমে রিজিকের প্রশ্ন আল্লাহর উপর অনড় নির্ভরতা, রিয়া তথা লোকদেখানো ইবাদতের ক্ষতি এবং তা থেকে বেঁচে থাকার উপায়, সেইসাথে ইবাদতে কীভাবে প্রেরণার সঞ্চার হবে তার বাস্তবিক উদাহরণ এবং যাবতীয় অধর্ম, আত্মগর্ব ও অহংকারের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার উপায়। সর্বশেষ হামদ ও শোকরের মকাম আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ, বান্দা পরিশুদ্ধ হয়ে উঠলে তাঁর মাঝে অটোমেটিক আল্লাহর বন্দনা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। সে একনিষ্ঠ কৃতজ্ঞ বান্দাতে রূপ নেয়। তাঁর এই অবস্থা হাসিল হয় নিয়মিত আল্লাহর গুণগান এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায়ের মাধ্যমে। আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ বান্দা যে কোনো সময় পা পিছলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পতিত হতে পারে, এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে চূড়ান্ত অধ্যায়টিতে।

সবমিলিয়ে ‘মিনহাজুল আবেদিন’ হতে পারে খোদার পথের পথিকদের দিশারি। অবশ্য কিতাবের দিকনির্দেশনা মেনে আমল করে যাওয়া বেশ কঠিন। এজন্য একজন বিশুদ্ধ মানুষ দরকার পড়ে। যাঁর দিকনির্দেশনার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে পর্যায়ক্রমে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। আর তাকেই পীর, মুর্শিদ, শায়খ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। দ

নবীজির যুগে বা সাহাবিদের যুগে কি তাসাউফ নামে কিছু ছিল?
হুবহু শব্দটা নির্দিষ্ট কোনো বর্ণনায় সেভাবে পাওয়া না গেলেও এর পরিপূরক শব্দের অস্তিত্ব ছিল দৃঢ়ভাবেই। দাতা গঞ্জে বখশ লাহোরি (রহ.) তাঁর কাশফুল মাহজুবে বর্ণনা করেছেন এ প্রসঙ্গে। তাসাউফ শব্দটি নবীজির যুগে না থাকলেও এর মূল বিষয়গুলো ইসলামে ছিল৷ তখন তাকে বলা হতো ‘তাজকিয়া’ বা ‘ইহসান’। তিনি বলেছেন, “যদি নাম নিয়ে সমস্যা হয় তাহলে কোনো সমস্যা নেই, তবে যদি তাসাউফের অর্থ ও মূল বিষয় অস্বীকার করো, তবে মনে রেখো এর দ্বারা কেবল শরিয়তকেই অস্বীকার করা হয় না; বরং নবীজির প্রশংসনীয় ফজিলত এবং সাহাবায়ে কেরামের উত্তম গুণাবলি তথা জীবনাচারকেই অস্বীকার করা হবে। কেননা এ ধরনের অস্বীকারের পর ধর্মের সবকিছুই রিয়া তথা লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত হয়ে যায়। কারণ, দ্বীনের মূল বিষয় হচ্ছে, ইখলাস ও মোহাব্বতের সাথে আল্লাহর হুকুমের অনুসরণ করা। যদি এটার অস্বীকার করা হয় তবে ধর্ম থাকেই বা কোথায়?”

যেমন আগে নামাজ শব্দ ছিল না, কিন্তু সালাত ছিল, রোজা না থাকলেও সাওম ছিল। স্থান-কাল-পাত্র আর ভাষাভেদে শব্দের পরিবর্তন বা নামের পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এইভাবেই তাজকিয়া আর ইহসান, কিংবা জুহদ, সুলুখ, আখলাক শব্দের পরিবর্তে কালক্রমে ‘তাসাউফ’ শব্দের প্রতিস্থাপন।

তাসাউফ সম্পর্কিত বিখ্যাত কিছু কিতাব হলো—
১. আল-ফাতহুর রাব্বানী ওয়াল-ফাইযুর রহমানী
–হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)
২. سر الأسرار (সিররুল আসরার)
–হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)
৩. إحياء علوم الدين (ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন)
–ইমাম আবু হামিদ আল-গাজালী (রহ.)
৪. المنقذ من الضلال (আল-মুনকিযু মিন আদ-দালাল)
–ইমাম গাজালী (রহ.)
৫. منهاج العابدين (মিনহাজুল আবেদিন)
–ইমাম গাজালী (রহ.)
৬. الرسالة القشيرية (আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ)
–ইমাম আবুল কাসিম আল-কুশাইরী (রহ.)
৭. طبقات الصوفية (তাবাকাতুস সুফিয়্যাহ)
–আবু আবদুর রহমান আস-সুলামী (রহ.)
৮. الفتوحات المكية (আল-ফুতুহাতুল মাক্কিয়্যাহ)
–মুহিউদ্দীন ইবনু আরাবী (রহ.)
৯. نفحات الأنس (নাফাহাতুল উনস)
–আবদুর রহমান আল-জামী (রহ.)
১০. الإنسان الكامل (আল-ইনসানুল কামিল)
–আবদুল করীম আল-জীলী (রহ.)
১১. عوارف المعارف (আওয়ারিফুল মাআরিফ)
–শেহাবুদ্দীন সুহরাওয়ার্দী (রহ.)
১২. الكشف المحجوب (আল-কাশফুল মাহজুব)
–দাতা গঞ্জে বখশ লাহোরি, আল-হুজবিরী (রহ.)
১৩. تذكرة الأولياء (তাজকিরাতুল আওলিয়া)
–ফারিদউদ্দীন আত্তার (রহ.)
১৪. الحكم العطائية (হিকামুল আতাইয়্যাহ – জ্ঞানগর্ভ বাণীসমূহ) – ইবনু আতাআল্লাহ আল-ইস্কান্দারী
১৫. التعرف لمذهب أهل التصوف (আহলে তাসাউফের মাজহাবের পরিচিতি) – আবু বকর আল-কলাবাযী
১৬. قوت القلوب في معاملة المحبوب ووصف طريق المريد إلى مقام التوحيد (কুতুল কুলুব – আত্মিক উন্নতির পথনির্দেশ) – আবু তালিব আল-মাক্কী
১৭. كتاب الزهد (কিতাবুয্‌যুহদ – পার্থিবতা বর্জনের শিক্ষা) – ইমাম আহমদ ইবনু হানবাল
১৮. كتب الزهد (যুহদ-বিষয়ক রচনাবলি) – ইমাম আলী ইবনু হুসাইন (জায়নুল আবেদীন)
১৯. الزهد الكبير (আল-যুহদ আল-কাবীর – বৃহৎ দুনিয়াবিমুখতার সংকলন) – ইমাম হাফিজ আবু বকর আল-বাইহাকী
২০. كتاب الزهد (কিতাবুয্‌যুহদ) – আবু দাউদ
২১. الزهد (আল-যুহদ) – ইবনু আবি আদ-দুনিয়া
২২. كتاب الزهد والرقائق (কিতাবুয্‌যুহদ ওয়ার্‌রাকায়েক – দুনিয়াবিমুখতা ও হৃদয় কোমলকারী উপদেশ) – ইবনুল মুবারক

Explore Our Beloved Sufis

Persian

শাহানশাহ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ছিলেন..

Persian

হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (১৮৬৫-১৯৩৭ খ্রি.), যিনি..

Persian

গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.)..

Persian

তাসাউফকে এককথায় ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। হজরত দাতা..

Persian

আল-হাসান আল-বসরীর উক্তিসমূহ: ১. “এই দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে..

Persian

ইসলামের ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁদের..

All Rights © SufiGraphy | Web Crafted by Sufi Media Solution (SMS).